সালটা ২০০৫, সবে ইঁটভাটার পরিযায়ী শ্রমিকদের শিশুদের নিয়ে স্কুল খোলার অনুমোদন পেয়েছি সরকারের পক্ষ থেকে দরকার পড়লো young energetic ছেলেমেয়েদের । যারা এঁদের কে মেন্টারিং করবে...
নিজের কলিগদের খুঁজতে বললাম । এক সিনিয়ার কলিগ খোঁজ নিয়ে এলেন একটি ছেলের - এসেই বললেন খুব বড়লোকের ছেলে পরীক্ষার পর পাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে বেশি মিশছে তাই বাড়ির লোকেরা কোথাও engage করতে চাইছেন। বললাম আনতে... পরের দিন যে interview দিতে আসলো, আমার ঘরে knock করে (খুব কম বাঙালী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এটা দেখি) যে ঢুকলও তাঁর বয়েস ১৯/২০ হবে। মাথাভর্তি চুল, রোগা প্যাংলা (আজ দেখে বোঝার উপায় নেই) - প্যান্টের বেল্ট দশবার করে প্রায় প্যাঁচানো - ঘরে ঢুকে wish করেই (এটাও বাঙ্গালীদের থেকে এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত) baritone voice এ জিজ্ঞেস করে - আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি - এতো রাগ হল - বললাম, একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো।
নেওয়া হল কাজে - বেশ ফাঁকিবাজ কিন্তু মুখে মারিতং জগত...আর অদ্ভুত ক্ষমতা লোকের সঙ্গে মেশার। সে যেই হোক এরকম sociable মানুষ খুব কম দেখা যায়। আর (আমায় ছাড়া আর) বাড়িতে মা ছাড়া কারোর ওপরে কখনও রাগ করে না । দেখলাম দুদিনেই অফিসের সবাই (আমি ছাড়া) সপ্তর্ষি বলতে অজ্ঞান... তখন ইউনিসেফ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে পুরুলিয়া পাঠানোর কথা হচ্ছে - শিশু শিক্ষা মিশনের শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রশিক্ষণের জন্য। আমাদের সাতকাহন বলে চাইল্ড রাইটস উইকে একটা সাতদিনের শিশু অধিকার বিষয়ে নানারকম ইভেন্ট চলত। সেইবার একদিন একটি প্যানেল ছিল উত্তর ২৪ পরগণার স্টুডেন্টস কাউন্সিলের একহাজার স্টুডেন্টসদের নিয়ে সঙ্গে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি, দেবাদিত্যবাবুর সঙ্গে। আয়োজন করা হয়েছিলো সল্টলেক ভারতীয়মে।
আগে প্রয়াসমের খাবারের ব্যাপারে একটাই নিয়ম ছিল - তা আনা হতো সবসময় ব্র্যান্ডেড দোকান থেকে। সেই প্যানেল ডিস্কাশানের দিন, সকালের জলখাবার অব্দি সব ঠিক ছিলও - দুপুরের খাবারের প্যাকেট ভারতীয়মে পৌঁছানর পর দেখা গেলো বাক্স থেকে বেশ বাজে গন্ধ বার হচ্ছে। যেভাবে সেইদিন সামাল দেওয়া হয়েছিলো তা আরেক গল্প...বিকেলে আমার সঙ্গে সপ্তর্ষি সেই প্রথম একা একটি এন জি ও ভিসিটে গিয়েছিলো - সারাদিনের টেনশান - ধকলে আমি প্রায় বিধ্বস্ত। ফেরার পথে হঠাৎ জিজ্ঞাসা - আমাদের আর্থিক কতো ক্ষতি হল...আর সেটা পূরণ হবে কি করে...আমি এটা সেটা বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম...ফস করে বলে বসল - আপনি আগামী মাসে আমাদের কাউকে স্যালারী দেবেন না - তাহলে অনেকটা সামলে যাবে না ? আমার সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় চলে গেলো কে জানে...স্যালারী কারোর কাটা হল না সেটা আলাদা ব্যাপার কিন্তু কটা মানুষ এই মনোভাব দেখাতে পারে তাও ঐ বয়েসে। তাও পরের বছর ডেকোরাম বিরুদ্ধ কাজ করার জন্য প্রয়াসমের একমাত্র কর্মী যাকে সাসপেন্ড করতে হল।
সপ্তর্ষির সবচেয়ে বড় গুণ হল ওর সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশতে পারার ক্ষমতা সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। আমার সঙ্গে যখন মালদা - পুরুলিয়া - বাঁকুড়া তে কাজ করেছে, বা পাটলিপুত্র - ভুবনেশ্বর - দিল্লিতে কিংবা বিদেশে নাইরোবি - লস এঞ্জালেস - নিউ ইয়র্কে - সব জায়গায় ওর ফ্যান ফলোয়িং চোখে পড়ার মতন । আজ আমাদের সঙ্গে যে ওয়ার্ল্ড ভিশান ইন্ডিয়া বা অ্যাডোবী কাজ করে তা অনেকটা সপ্তর্ষির জন্যও । নিজের চেষ্টায় সপ্তর্ষি কম্পিউটার শিখেছে এবং মনিষদের শিখিয়েছে। ঠিক ক্যামেরা বা এডিটিং এর বেলাতেও তাই। আমাদের এখানে যে টেকনিশিয়ান্সরাই কাজ করুন তাঁরা সপ্তর্ষির সবাই শিখেছে আমার এই বন্ধুর কাছেই। English এ একটা শব্দ আছে unassuming... সপ্তর্ষির ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য।
আমার সঙ্গে ওর ঝামেলার শেষ নেই। মানে ১৮ বছরে প্রায় ১৮০০ বার আমায় "হুমকি" দিয়েছে - কাল থেকে আর আসবোনা আমার resignation letter টা স্যার একটু লিখে রাখবেন - পরেরদিন যথাসময়ে এনাকে হাজিরা দিতে দেখা যায়। ২০১৪ সালে বিয়ে করলো - ঠিক তার কয়েকদিন আগে অফিসের সঙ্গে বড়ন্তি তে retreat এ গিয়ে উদ্দাম হয়ে কবাডি খেলে পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে আসলো । বিয়ে হল মোড়ায় বসে। বিয়ের শপিং, ভাগ্যিস সেটা আগে সারা হয়েছিলো, বাড়িতে জানিয়ে দেওয়া হল স্যার সব কিনে দেবেন - ভাবুন তো কি বিপদ - কনিষ্ক / বাইলুমে গিয়ে সব কেনা হল। পূজোর সময় আমার অভ্যাস আমার কলিগদের গিফট দেওয়া - তার আবদার হল পাঁচদিনে পাঁচটা জামা কিনে দিতে হবে যা পরে তিনি পাগলের মতো ঠাকুর দেখে বেড়াবেন। বোঝো।
এখন প্রয়াসম ভিস্যুয়াল বেসিক্স প্রোডাকশান হাউস নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত। তার মধ্যেই সামলাতে হচ্ছে ট্রেনিং। নতুন বাছাই। ফিল্মের স্ক্রিপ্ট দেখা, শ্যুটিং এর প্ল্যানিং আর মোহনবাগান - আর্জেন্টিনা তো আছেই। সপ্তর্ষির আরও একটা ব্যাপার হল ও খেতে এবং খাওয়াতে দারুণ ভালোবাসে । অসম্ভব ভালো পাস্তা রাঁধে । রান্নার পর কিচেন পরিষ্কার করতে প্রায় দশদিন লাগে সেটা অন্য ব্যাপার, কিন্তু রাঁধে চমৎকার । এখনও বাচ্চামোটা পুরোদস্তুর রয়েছে । সঙ্গে আছে একরোখামি । একসময়ে ভালো ফুটবল খেলতো সেই খেলোয়াড়ি মেজাজ আজও রয়েছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ওর এই মনোভাবকেই জানাই কুর্নিশ। ঠিক এই সময়ে প্রয়াসমের এইরকম মানুষেরই দরকার প্রয়াসমে।
প্রচুর কথা মনে ভিড় করে আসছে কিন্তু তা বলতে গেলে এই লেখা শেষ করা মুশকিল। তাই আজ এই পর্যন্তই। যারা পড়বেন এই লেখা তাঁদের যদি সপ্তর্ষিকে নিয়ে কিছু বলার থাকে kindly কমেন্টে লিখবেন ওঁর ভালো লাগবে।
Σχόλια