১৯৭১ এ Bangladesh Liberation War এর সময় আমরা রাজভবনে থাকতাম। বয়স চার কিন্তু কয়েকটা ব্যাপার মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো - ব্ল্যাক আউট, রাত্রে সাইরেনের শব্দ, জানালা কাগজ
বা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা, নিয়াজী, (যার নাম আমার নাড়ু কাকু মজা করে বলতেন, পেঁয়াজী) বড় হয়ে জানলাম এনার নাম আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী যিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফট্যানেন্ট জেনারেল। খুব আবছা মনে আছে রাজভবনে ইন্দিরা গান্ধী-র আসা, তাঁকে বাঙ্গালী কায়দায় শাড়ি পড়ানো এবং খোলা জীপে মুজিবুর রহমান এর সঙ্গে কোথায় একটা বক্তৃতা দিতে যাওয়া - কাতারে কাতারে মানুষ রাজভবনের গেটের বাইরে - অংশুমান রায়ের গলায় - বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ গানটি, সঙ্গে তাঁর ইংলিশ ভারসান - আমার মানি ইপি রেকর্ডটি সিম্ফনি থেকে কিনে এনেছিলেন - সে সময় প্রতিদিনই প্রায় শোনা হতো । দিদি গাইতো ইংলিশ গানটি।
১৯৭৩ সালে দেখলাম চেতন আনন্দের হিন্দুস্তান কি কসম - Squadron Leader Rajeev Shukla কে তখন প্রায় মনে হচ্ছে নিজের খুব কাছের লোক । বড় হয়ে রাজকুমারের অভিনয়ের আমি একেবারেই ভক্ত ছিলাম না। যাই হোক এই সিনেমার দুটি গান সেই বয়েসেই আমাকে দারুণ নাড়া দিয়েছিলো । একটি এর টাইটেল সং, অন্যটি পর্দায় প্রিয়া রাজবংশের মুখে লতা মঙ্গেশকারের গলায় Hai Tere Saath Meri Wafa
এতো প্যাথোস যে গানটি আমার অল টাইম ফেভারিটের তালিকায় রয়ে আছে অনেকদিন থেকে। সেই সময় থেকেই কোনও একটা কিছু করলে সেটাতে পুরোপুরি নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে হবে এই ব্যাপারটা চলে আসে। মানে কোনকিছুই half hearted way তে করা হয়ে ওঠেনা - সেটা বাড়ি সাজানোই হোক বা প্রয়াসম। কাউকে ফলস প্রমিস দেওয়া বা কারো কাজ স্যাবোট্যাজ করা এগুলো মাথাতেও আসেনা - আর তাই গত ২৪ বছর প্রয়াসম নিয়েই পুরো ভরে আছি।
সিনেমা আমার কাছে কখনই নিছক বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি। তাই কোনও ফিল্ম যদি দেখি সস্তা চাকচিক্যের ভারে ন্যুব্জে আছে আমি তাকে অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করি। যে কারণে করণ জোহার বা সঞ্জয় লীলা -র ছবি আমাকে যতোটা না টানে তার চেয়ে অনেক বেশি আমাকে ভাবায় মারাঠি, অসমীয়া বা দক্ষিণের নতুন কিছু পরিচালকের কাজ। সিনেমার কনটেন্ট না টেকনিক তা নিয়ে তাবড় তাবড় লোকেরা কথা বলেছেন - তাই সে তর্কে না যাওয়াই ভালো। তবে এটুকু বুঝি একটা ভালো গল্প থাকলে সঙ্গে একজন ভালো পরিচালক জুটে গেলে আমরা "পথের পাঁচালী" / "অপরাজিত" পেয়ে যাই । যাই হোক ফিরে আসি আজকের প্রসঙ্গে - পাপার রেকমেন্ড করা কয়েকটা ফিল্ম অনেক ছোটবেলায় আমাকে নাড়া দিয়েছিলো, যার মধ্যে ডক্টর কোটনিশ কি অমর কাহানী অন্যতম।
এই সিনেমাগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রদের দৃঢ়তা - তাদের অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করার শক্তি কি করে জানি যখন প্রয়াসম চালাতে শুরু করলাম তখন থেকেই মাথাতে গেড়ে বসেছিলো। যেন যে কাজটা করতে নেমেছি সেখান থেকে কখনও সরে না আসি। তাই প্রতিকূলতা এসেছে কিন্তু প্রশ্রয় দিইনি অন্যায়কে। লোকে কি বলবের চেয়ে বারবার ভাবি আমরা নিজেকে কি বলবো। আমি জানি সুজিত সেলিম মনিষ ও আরও অনেকে যারা আমার অনট্র্যাকের স্টুডেন্ট ছিলো, তারা আমার অনেক ইম্পালসিভ ব্যাপার স্যাপারের সাক্ষী কিন্তু তাঁরা কখনও দেখেনি আমাকে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে। এই ব্যাপারে আমি পিয়ালীদিদি, দেবাশীষ আর সপ্তর্ষির কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
প্রয়াসম আমাদের কাছে একটা মুভমেন্ট । একটা সিস্টেম । যে সিস্টেমে ঢোকা যেমন মুশকিল একবার ঢুকলে তার থেকে বার হওয়া আরও বেশি কষ্টকর। এই বলে ভাবার দরকার নেই যে প্রয়াসম ছেড়ে কেউ যাচ্ছে না - লোক তো আসবে যাবেই কিন্তু যে ছাপটা নিয়ে সে বার হবে সেটা মুছে ফেলা বেশ কঠিন। তাই যখন লোকেরা এসে বলে তাঁরাও আমাদের মতো "কাজ" করছে - ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টের কাজ করছে, আগে রাগ হলেও এখন আর হয়না - ফার্স্ট অব অল তাঁরা বোঝেননা যে এটা আমাদের কাছে কোনও টাইম বাউন্ড প্রজেক্ট না যে টাকা না থাকলেই গুটিয়ে নিতে হবে। আমাদের এই কাজে টাকা তো দরকার নিশ্চয়ই তবে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি দরকার এক সঙ্গে মিশে কাজ করার মানসিকতা, একে অপরকে বোঝা - ডিজাইন থিঙ্কিং বলে একটা ব্যাপার আছে সেটা কে ঠিকঠাক মতো বোঝা। গরিব পেটাপিটি তো অনেক হল এইবার কি একবার ভেবে দেখবো আমরা যারা "গরিব উদ্ধারে" নেমে পড়েছি তাঁরা বেসিক্যালি নিজেরা কতোটা নিঃস্ব। নাকি "বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই" হয়ে কাটাবো চিরটাকাল।
তাই যখন ইউনিসেফ বলে যে প্রয়াসম কে কাজ দিয়ে কখনও ভাবতে হয়না সেটা হবে কিনা ওরা আমরা দেখি না দেখি কাজটা চালিয়ে নিয়ে যাবে নিজেদের তাগিদে - আমরা একমত হই। হ্যাঁ, এই কাজের মারাত্মক ক্ষিদে রয়েছে সবার মধ্যে। আর সেই কারণে কর্তব্যে অবহেলা কাউকে করতে দেখিনি। কোনোদিন না। কেউ কাল অন্য জায়গায় যাবে তা বলে আজ গাফিলতি - হারগিস না। এই কমিটমেন্ট লেভেল যতদিন থাকবে প্রয়াসম ততদিন "এন জি ও" হবে না। আমাদের প্রত্যেকটি লোক তাঁদের সবরকমের বাধা-বিপত্তি নিয়েও ইউনিক। তাই এঁদের মধ্যেই আমি প্রত্যক্ষ করি Squadron Leader Rajeev Shukla এর মাথা না নোয়ানোর ক্ষমতা কে বা ডক্টর কোটনিশের জেদ কে। আর তাই একটু ঘুরিয়ে বলি সার্থক জনম আমার আনতে পেরেছি এই কাজের আনন্দ কে।
Kommentare